জীবন ও জীবিকার সন্ধানে

সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২০

ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালির অহংকার

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অমর হোক

পৃথিবীতে একটি মাত্র জাতি আছে  যারা নিজের ভাষা, মায়ের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছে, আর সে জাতি হলো বাঙালি জাতি । একটি জাতির পরিচয়ের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হলো তার ভাষা, যেমন - ফরাসি জাতির ভাষা -ফরাসি, ইংরেজ জাতির ভাষা - ইংরেজি, পুর্তগিজ জাতির ভাষা- ফুর্তগিজ তেমনি বাঙালি জাতির ভাষা হলো বাংলা । কোন জাতির যদি তার নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার না থাকে তাহলে সে জাতির আর কি থকে?  বাঙালি জাতির এই প্রাণের প্রিয় ভাষাকে কেড়ে নিয়ে বাঙালীকে নিঃস্ব ও চিরতরে ভিখারি করতে চেয়েছিল- পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী । কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বাঙালি ধূলিসাৎ করেদিয়েছে - নিজেদের প্রাণ দিয়ে । পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে বাঙালি বুঝিয়ে দিয়েছে - আমরা নিজেদের প্রাণ দিতে পারি ; ভাষা নয় । ভাষা আন্দোলন কারী  সে দিনের সেই দামাল ছেলেদের প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি রক্ষা করলো তাদের সম্মন, ইজ্জৎ আর পেল আন্তর্জাতিক পুরস্কার - "আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি । আসুন জেনে নিই, কেমন করে এলো - আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

১৯ ৪৭ সালে পাকিস্তানি জাতির জনক জিন্নাহ'র দ্বি জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে ভারত বর্ষ ভাগ হলো । ইসলাম ধর্ম পেল পাকিস্তান আর হিন্দু ধর্ম পেল হিন্দুস্তান । সেই সময়ে বর্তমান বাংলাদেশের ধর্ম প্রাণ মুসলিমরা খুশি হয়ে পাকিস্তান অংশে নিজেদেরকে শামিল করে নিল ; তাদের মনে ক্ষুণাক্ষরেও সন্দেহ ছিলনা যে পাকিস্তানিরা মুসলমান হয়ে বাঙালি মুসলমানের উপর অত্যাচার করবে । কিন্তু তাদের ( বাঙ্গালীদের ) সে বিশ্বাস অল্প কিছু দিন পরেই ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল, যখন ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ  মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার  রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশে ঘোষণা দিলেন -

উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা ।
সেই সমাবেশ থেকেই বিদ্রোহ শুরু । সমাবেশে উপস্থিত জনতার একটি  অংশ বিদ্রোহ করে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই শ্লোগান দিতে দিতে সমাবেশ স্থল ত্যাগ করেন কিন্তু জিন্নাহ তার বক্তব্য বন্ধ করেননি । জিন্নাহকে সমর্থন দিয়ে তার বক্তব্য শুনে যাচ্ছিল সেই সময়ের - মুসলিমলীগাররা ।


বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার  দাবীতে সর্ব প্রথম ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে  ভাষা আন্দোলন  শুরু করে-  তমদ্দুন মজলিস । তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে  ফজলুল হক হলে এক সভায় - বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপরেখা প্রণীত হয় । ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর হাজার হাজার বাঙালীর স্বাক্ষর সংবলিত একটি স্মারকপত্র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে দেওয়া হয় । ১৯ ৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতা মিছিল করে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী জানায় । একই বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ । এই রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ মহান ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে । রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- সামসুল আলম, আবুল খায়ের, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী ও অলি আহাদ এবং পরবর্তীতে সদস্য হিসেবে যোগ দেন - মোহাম্মদ তোয়াহা ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম । ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ।


২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত  বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পার্লামেন্টে বিল উত্থাপন করেন , সেই বিলে মাওলানা ভাসানী ও গুটি কয়েকজন সমর্থন দিলেও বেশিরভাগ মুসলিম লীগার এম, পি এর বিরোধিতা করেন , ফলে বিলটি বাতিল হয়ে যায় । এই বিল বাতিল করতে খাজা নাজিম উদ্দিন অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ।


২৪শে মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন -

পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে ।
তখন ছাত্ররা দাঁড়িয়ে নো নো বলে প্রতিবাদ করে আর ভাষা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ।


৩১শে জানুয়ারী ১৯৫২ সালে মাওলানা ভাসানীর ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক  পেশাজীবীরা সম্মেলনে যোগ দিয়ে   সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে । এই  সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ  ২১ শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে । এটি ছিল মহান ভাষা আন্দোলন এর টার্নিং পয়েন্ট । 


১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশে পাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি  ভাষা আন্দোলন এর মাহেন্দ্রক্ষণ

একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সকাল ৯ টা থেকে ছাত্র সমাজ  ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেইটের পাশে সমবেত হতে থাকে ।


সকাল ১১ টা : কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু । সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় । আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করেন ।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন ।


বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা : উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন । এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যু বরণ করেন । পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃত্যু বরণ করেন । অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় । আমরা রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলন সফল করেছি । 


অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন

বেলা ৪টা : ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে ।  গুলিবর্ষনের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবী করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন । সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকন্ঠ হন কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন । এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন । রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহবান সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয় । ইউকিপিডিয়া 


এভাবেই বাঙালি ধর্মীয় আভরণ থেকে বেড়িয়ে ভাষা ভিত্তিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে । আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে পালিত হয়। এখন জানব কে বা কাদের প্রচেষ্টায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল ।


মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী

এই সংগঠনটি কানাডার বহুজাতিক ও বহুভাষিক মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী । এটি ১৯৯৮ সালে জাতি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস " হিসেবে একটি দিবস প্রচলন করার প্রস্তাব উপস্থাপন করে । কানাডা প্রবাসী দু'জন বাংলাদেশী এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন । তাঁরা হলেন - আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম । মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠীর প্রস্তাবিত চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি ও ভাষার ১০ জন সদস্য । তাঁরা তাদের চিঠিতে বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলন ও লড়াইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মহাসচিবকে বুঝাতে চেয়েছিল । কিন্তু মহাসচিবের অফিস থেকে তাঁদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়  যে - এ ব্যাপারে নিউইয়র্কে নয় , যোগাযোগ করতে হবে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা , বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক  সংগঠন ইউনেসকোর সঙ্গে । এরপর প্রায় এক বছর পেড়িয়ে যায় কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি ইউনেসকো কিন্তু দমে যাননি মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী ও আব্দুস সালাম আর রফিকুল ইসলাম ।

আন্না মারিয়া

১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ ইউনেসকো ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে চিঠির মাধ্যমে জানান যে- 

" ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাবটি বেশ আকর্ষনীয় মনে হয়েছে কিন্তু বিষয়টি ব্যাক্তিগত ভাবে উত্থাপনের সুযোগ নেই , ইউনেসকোর পরিচালনা পর্ষদের কোন সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে , সভায় এটি তুলে ধরতে হবে ।"
সেই সাথে ইউনেসকোর পরিচালনা পর্ষদের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রের নাম ঠিকানাও দিলেন - আন্না মারিয়া । এতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরির নাম ছিল । দেশের নামগুলো দেখেই বুঝা যায় যে আন্না মারিয়া বাংলাদেশের বন্ধপ্রতিম রাষ্ট্রের তালিকা দিয়েছে , যাতে করে সম্মতি আদায় করতে বেগ পেতে না হয় ।


কানাডা থেকে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে মন্ত্রণালয় অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুমতি চেয়ে নোট পাঠায় । বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়স্বল্পতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন । তিনি সব ধরনের জটিলতা উপেক্ষা করে নথি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ইউনেসকোর সদর দপ্তরে সরাসরি প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন । ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের পক্ষে এর সচিব অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরিত সেই প্রস্তাবটি প্যারিসে পৌঁছায় ।


তখন ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশন এবং ৩০তম সাধারণ সম্মেলন ছিল । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের বিষয়টি নিয়ে ইউনেসকোতে দুটি সমস্যা দেখা দেয় । প্রথমত, ইউনেসকো ভেবেছিল, এমন একটা দিবস পালন করতে গেলে বড় অঙ্কের টাকাপয়সা প্রয়োজন হবে । খরচের কথা ভেবে প্রথমেই প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় । একই সঙ্গে ইউনেসকো মহাপরিচালক International Mother Language Day নয়, International Mother Tongue Day নামে একে পরিচিত করতে চান । মহাপরিচালক এ জন্য এক লাখ ডলারের ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করেন এবং দুই বছর পর নির্বাহী পরিষদের ১৬০তম অধিবেশনে একটি সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার আদেশ দেন ।


এর ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার বিষয়টি আটকা পড়ে । প্রস্তাবটি কার্যকর হতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে বলে মনে করা হয় । এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক । তিনি ছিলেন ওই অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা। তিনি অধিবেশনের বক্তব্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাৎপর্য সবার সামনে তুলে ধরেন । এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠক করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পক্ষে জনমতও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন । এমনকি উপস্থিত সদস্যদের বোঝাতে সক্ষম হন, দিবসটি পালন করতে প্রকৃতপক্ষে ইউনেসকোর এক ডলারও লাগবে না । পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ নিজেরাই নিজেদের মাতৃভাষার গুরুত্ব আলোচনা ও জয়গান গাইতে গাইতে দিনটি পালন করবে ।


এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ডকুমেন্টেশন পুস্তিকায় সদস্যসচিব ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক একই সঙ্গে কতকগুলো ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালান । এক রাতে তিনি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের নেতার সঙ্গেও একটি বৈঠকের আয়োজন করেন । প্রস্তাবটিতে পাকিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন ছিল । কারণ, যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন ঘিরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল, তাতে পাকিস্তানের মনোভাবে অবশ্যই না-বাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা ছিল । এ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরবের সমর্থনের ক্ষেত্রেও সে দেশের ইতিবাচক ভূমিকা প্রভাব ফেলতে পারত । ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানে সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল । ফলে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী সে বছর ইউনেসকো সম্মেলনে যাননি, পাকিস্তানি দলের নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব । বৈঠকে এ এস এইচ কে সাদেক আবিষ্কার করেন, পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব একসময় তাঁর অধীনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কাজ করেছেন । আরও মজার বিষয়, পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব বাংলায় চমত্কার কথা বলতে পারেন । ফলে এ বৈঠক খুবই সফল হলো । তিনি প্রস্তাবটি সমর্থনের আশ্বাস দেন ।


ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তাদের আপত্তি ছিল না । তবে তারা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল । পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে শিক্ষামন্ত্রী যুক্তি ও আবেগের সঙ্গে এই বিষয়টি তুলে ধরেন যে পৃথিবীতে বাঙালিরা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে । সেটা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে । তখন ইউরোপীয়রা ব্যাপারটা বুঝতে পারে ।


এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হওয়ার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারি লাভ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা । ইউনেসকোর ঐতিহাসিক সেই অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ এবং সৌদি আরব । আর সমর্থন করেছিল আইভরি কোস্ট, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কমোরোস, ডমিনিকান রিপাবলিক, পাকিস্তান, ওমান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, বাহামাস, বেনিন, বেলারুশ, গাম্বিয়া, ভারত, ভানুয়াতু, মাইক্রোনেসিয়া, রুশ ফেডারেশন, লিথুয়ানিয়া, মিসর, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া ও হন্ডুরাস ।


১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ শুধু বাংলা ভাষার বিশ্ববিজয় নয়; পৃথিবীর সব মাতৃভাষার বিজয় । প্রথম আলো 


বাংলাদেশে এই দিবসটি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় । 

আরো পড়ুনঃ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের অপ্রাপ্তির খাতা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ভদ্রতা ও শালীনতার সহিত মতামত দিন